তসলিমাকে ভালোবেসে রুদ্র “সকাল ” বলে ডাকতো। কবিতাতেও এই নামে ডেকেছে তাকে :
“সেই যে আমি স্বপ্নে ভীষণ রক্ত দেখি,
টকটকে লাল রক্ত দেখি
সেই যে আমি রাত্রে চোখে ঘুম আসে না
চোখ বুজলেই মিছিল দেখি, বুলেটবিদ্ধ মানুষ দেখি
সেই যে আমি একটুখানি স্নেহের কাঙ্গাল, মনে পড়ছে ?
সেই যে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, দ্বিধাগ্রস্ত
দাঁড়িয়েছিলাম, মনে পড়ছে ? সকাল, তোমার মনে পড়ছে ?”
রুদ্রর কাছে শেষবারের মতো লেখা তসলিমার খুব সুন্দর চিঠিটির “পুনশ্চ ” অংশটুকু,
” আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি।
কতোকাল ঐ ডাক শুনি না। তুমি কি আকাশ থেকে
সকাল, আমার সকাল বলে মাঝে মধ্যে ডাকো?
নাকি আমি ভুল শুনি?”
“সময় যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত নিয়ে নয়।” টেকেনি তাদের প্রেম। মধুর সম্পর্ক গড়ালো বিষে। বিচ্ছেদের পর রুদ্রর ব্যাপারে একটা কবিতায় তসলিমা লিখেছিলো,
“তার চেয়ে কুকুর পোষা ভাল
ধূর্ত যে শেয়াল, সেও পোষ মানে।
দুধ কলা দিয়ে আদরে আহ্লাদে এক
কবিকে পুষেছি এতকাল।
আমাকে ছোবল মেরে
দেখ সেই কবি আজ কীভাবে পালায়”।
বিপরীতে রুদ্র লেখে এই কবিতাটি :
“তুমি বরং কুকুর পোষো,
প্রভুভক্ত খুনসুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়,
তোমার জন্য বিড়ালই ঠিক,
বরং তুমি বিড়ালই পোষো
খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়
লক্ষী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো
শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়,
কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান।
ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি,”
এহেন তসলিমা নাসরিন এবং রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-র কবিতার আশ্রয়ে ৭ জুন, ইফটা-র প্রযোজনায় থিয়ে অ্যাপেক্সে মঞ্চস্থ হয়ে গেল ‘রুদ্রকে লেখা চিঠি’। নাটকটি পরিচালনায় ছিলেন দেবাশিস দত্ত। এই নাট্য দুই কবির প্রেম-অপ্রেম, মিলন-বিচ্ছেদ এবং ক্ষয় ও ভাঙনের একান্ত ব্যক্তিগত যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুহূর্তগুলো তুলে ধরে। তাই এই নাটক শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত হয়ে থাকে না। বরং তাদের সম্পর্কের আয়নায় আমরা যেন নিজেদের দেখতে পাই। দেখতে পাই, এই ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের যুগে ভালোবাসার মানুষগুলোরও একে অপরের প্রতি বিষিয়ে ওঠা দাঁত নখ আর আক্রমন প্রতিআক্রমনের চেনা ছবি। তবুও ভালোবাসার জয় হয়, অন্তত সে বিশ্বাস নিয়েই মানুষ বাঁচে। এ নাটক বিদ্বেষ ঘৃণা অতিক্রম করে সেই চিরন্তন ভালোবাসার কথা বলে। আসলে এ নাটক যেন মঞ্চে লেখা একটি কবিতা। মঞ্চের সামান্য কিছু উপকরণ এবং একটি ফাঁকা ফ্রেম গভীর নান্দনিক অভিঘাত তৈরি করে দর্শকমনে। রুদ্র চরিত্রে দেবাশিস দত্তর গভীর মননশীল অভিনয় মনে দাগ কাটে। তসলিমার চরিত্রে দেবযানী মুখার্জির স্বতস্ফূর্ত অভিনয় ও গান প্রসংশার দাবী রাখে । নেপথ্যের প্রতিটি বিভাগও দক্ষতার সঙ্গে সমৃদ্ধ করেছে এই নাট্য প্রযোজনাটিকে। আলোয় প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্য্য, আবহে কৃশানু ব্যানার্জী এবং প্রজেকশনে ছিলেন শুচিস্মিতা রায় এবং প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণে সুরিন্দর সিং।