সোনারপুরের তেঘরিয়া বিদ্যাপীঠের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক শ্রী নিতাই নস্কর, যিনি অভিনেতা/সমাজকর্মী/অভিনয় প্রশিক্ষক ববি চক্রবর্তীর বিশ্বব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মসূচি ‘আই অ্যাম দ্য কিং অফ মাই মাইন্ড’-এর একজন সক্রিয় সমর্থক এবং শক্তিশালী সৈনিক ছিলেন, তিনি গত ১২ অক্টোবর ২০২৫,৭৪ বছর বয়স হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

নিতাই স্যারের হৃদয়ের খুব কাছের ছিলেন ববি, যিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ সৈনিককে চোখের জলে শ্রদ্ধা জানালেন :-
“আমি ২০১২ সালে তেঘরিয়া বিদ্যাপীঠে আমার আসক্তি বিরোধী অভিযানের জন্য গিয়েছিলাম, তখন নিতাই স্যারের সাথে আমার আলাপ। তিনি ইতিমধ্যেই সেই স্কুল থেকে অবসর নিয়েছিলেন, কিন্তু স্কুল কমিটি তাকে অনুষ্ঠানের অংশ হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তিনি পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে বসে ছিলেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসম্ভব উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেছিলেন। অধিবেশন শেষ হওয়ার পর, তিনি বলেছিলেন, “ববি তোমার এই সচেতনতামূলক কর্মসূচি চমৎকার তথা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ২৪ পরগনা (দক্ষিণ) এর সকল সরকারি স্কুলে এটি পৌঁছানো উচিত। আমি তোমাকে এতে সাহায্য করব”…এবং এইভাবে নিতাই স্যার এবং আমার আসক্তি বিরোধী অভিযানের দীর্ঘ যোগাযোগ শুরু হল।
তিনিই নিজদায়িত্বে ৪০টিরও বেশি গ্রামীণ স্কুলে আমার এই অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, যার সবগুলোই ছিল দক্ষিণের ২৪ পরগনায়, যেখানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে ভ্রমণ করতেন এবং সেশনগুলোতে উপস্থিত থাকতেন… আমার মতোই এই কাজের প্রতি একই রকম আবেগ এবং দায়িত্ববোধ ভাগ করে নিতেন। এমন আন্তরিক উদ্যম, আমি অন্য কারো মধ্যে কখনও দেখিনি,শিক্ষাঙ্গনে ত বটেই বা অন্য কারও মধ্যে!

একজন সমাজকর্মী হিসেবে আমার জীবনের গত দুই দশকে, শিশুদের মধ্যে সকল ধরণের আসক্তি (সিগারেট/মদ্যপান/স্মার্ট ফোন) এবং ক্ষতিকারক সামাজিক প্রবণতা (অপমানজনক ভাষা/অনলাইন অশ্লীলতা জনপ্রিয় হবার জন্য/গুন্ডামি/র্যাগিংয়ের/গেমের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া) এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছি… বিনামূল্যে । আমার এই কঠিন যাত্রাপথে ৩ ধরণের মানুষের সাথে দেখা হয়েছে :-
১) (ক) যারা সুরক্ষিত,স্বচ্ছল, শক্তিশালী এবং সুসংযুক্ত… এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই… স্বচ্ছলতা/ক্ষমতা একজন ব্যক্তির সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ধ্বংস করে দেয়, যারা এই সামাজিক কুকর্মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা বা সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া সম্পর্কে আর একটুও মাথা ঘামাতে চায় না।
(খ) যারা যুবসমাজের মধ্যে বিদ্যমান এই অন্ধকার সম্পর্কে জেনেও তাদের নিজস্ব কল্পনার জগতে বাস করে। তাদের চারপাশে এক স্বর্গীয় ছবি এঁকে, একটি বুদবুদের মধ্যে বেচেঁ থাকে তারা, বাস্তবকে অস্বীকার করে । তাই এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বা আমার সাথে সহযোগিতা করার জন্য একেবারেই উদ্যমী নন তারা।
(গ) যারা নিজেরাই এই কুকর্মের গভীরে আবদ্ধ এবং তাই তাদের মধ্যেকার আসক্তির দানব, তাদের এইসবের বিরুদ্ধে সচেতনতা ছড়াতে বাধা দেয়।
এই প্রথম শ্রেণীতে, আমি যাদের চিনি বা আমার জীবনে এখন পর্যন্ত যাদের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, তাদের ৯০% অন্তর্ভুক্ত।
২) এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষদের সাথে আমার দেখা হয়েছে, যারা এখন পর্যন্ত আমার মোট পরিচিতদের ৮%, খুবই চমকপ্রদ। এখানে আমি সেই অদ্ভুত মানুষদের কথা বলতে চাইছি, যারা আমাকে এবং আমার এই কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ঠিকই, কিন্তু অত্যন্ত ‘গোপনে’!তারা কিন্তু এই সচেতনতার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন, আমার সাথে সহযোগিতাও করেছেন, অথচ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল এই সহযোগিতাকে ভীষনভাবে গোপন রাখার… যাতে আমার এই কাজের সাথে তাদের সম্পর্ক প্রকাশ্যে না আসে!!
৩) বাকি ২% জন হলেন আমার দেখা সেই সব অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যারা আমার মতোই সমানভাবে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল এবং যুবসমাজের জন্য, যারা আসলে আমাদেরই ভবিষ্যৎ, তাদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য আমার সাথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কোনও বস্তুগত লাভের কথা মাথায় না রেখে। তারা সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজন, যারা তাদের ভালো কাজের মাধ্যমে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চেয়েছন আমার সাথে এবং নিতাই স্যার অবশ্যই এই বিরল ২% রত্নদের শীর্ষে আছেন !
২০১২ সালের অধিবেশনের পর তিনি আমাকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রতিটি প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে, সেই স্কুলগুলিতে আমার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এই ‘আয়োজন করা’ এমন একটি কঠিন প্রক্রিয়া যা আমি প্রতিদিন অনুভব করি, সারা বিশ্বের হাজার হাজার শিক্ষক/প্রতিষ্ঠানের প্রধান/প্রশাসকদের সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করার সময়। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তাদের মধ্যে সেই বিরল ২% খুঁজে পাওয়া কতটা কঠিন ।যদিও এই সচেতনতা সময়ের ডাকে অতি প্রয়োজনীয়…যদিও যুবসমাজ গুরুতর বিপদের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে…যদিও আমি এটি বিনামূল্যে করি… তাও আমি নিজে জানি ওই ২% মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া কতটা দুষ্কর!!
প্রিয় নিতাই স্যার, আপনার উদ্যোগে আমরা যে সমস্ত গ্রামীণ স্কুলে একসাথে ভ্রমণ করেছি, সেখানে আপনার সাথে আমি কিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আপনি সর্বদা আমাকে আমার লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন, যেকোন প্রতিকুলতার মধ্যেও ! আমি আনন্দিত যে ২০১৭ সালে আপনার নিজের স্কুলের দ্বিতীয় অধিবেশনে আপনাকে সংবর্ধনা জানাতে পেরেছি। আপনার মতো সৎ, উষ্ণ হৃদয়ের এবং মূল্যবোধে পরিপূর্ণ একজন ব্যক্তি আজকের পৃথিবীতে বিরল, যা প্রতারক এবং অহংকারী মানুষের দ্বারা প্লাবিত। আপনি আমার জন্য একজন পিতৃসম ব্যক্তিত্ব এবং আমার মনে হয় এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের জন্য আমি আমার বাবাকে হারালাম! আপনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি স্যার।